what image shows

বিজ্ঞান

অষ্টম শ্রেণি


তৃতীয় অধ্যায় : ব্যাপন, অভিস্রবণ ও প্রস্বেদন


উদ্ভিদ মূলের সাহায্যে মাটি থেকে পানি ও পানিতে দ্রবীভূত খনিজ লবণ শোষণ করে এবং সেই পানি ও রস কাণ্ডের ভিতর দিয়ে পাতায় পৌছায়। আবার দেহে শোষিত পানি উদ্ভিদ বাষ্প আকারে দেহ থেকে বের করে দেয়। উদ্ভিদরা যে সব প্রক্রিয়ায় কার্বন ডাইঅক্সাইড ও অক্সিজেন গ্যাস গ্রহণ করে এবং ত্যাগ করে, দেহে পানি ও পানিতে দ্রবিভূত খনিজ লবণ শোষণ করে ঐ রস দেহের নানা অঙ্গে পরিবহন করে ও দেহ থেকে পানি বাষ্প আকারে বের করে দেয় সেই সব প্রক্রিয়া ব্যাপন, অভিস্রবণ, শোষণ, পরিবহন ও প্রস্বেদনের মাধ্যমে ঘটে। এই অধ্যায়ে এ বিষয়গুলো আলোচনা করা হলো।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-
* ব্যাপন প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে পারব।
* অভিস্রবণ প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে পারব।
* প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদের পানি পরিত্যাগ ব্যাখ্যা করতে পারব।
* উদ্ভিদের পানি শোষণ ব্যাখ্যা করতে পারব।

পাঠ ১ ও ২ : ব্যাপন
আমরা জানি সব পদার্থই কতগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণু দিয়ে তৈরি। এই অণুগুলি সবসময় গতিশীল বা চলমান অবস্থায় থাকে। তরল ও গ্যাসের ক্ষেত্রে অণুগুলির চলন খুব দ্রুত এবং বেশি ঘনত্বের স্থান থেকে কম ঘনত্বের দিকে অণুগুলি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এই চলন চলতে থাকে যতক্ষণ না অণুগুলির ঘনত্ব দুই স্থানে সমান হয়। অণুগুলির এরূপ চলন প্রক্রিয়াকে বলে ব্যাপন। ব্যাপনকারী পদার্থের অণু-পরমাণুগুলির গতিশক্তির প্রভাবে এক প্রকার চাপ সৃষ্টি হয় যার প্রভাবে হালকা তুঁতের কেলাস নীল পানি নীল পানি ঘন

অধিক ঘনত্বযুক্ত স্থান থেকে কম ঘনত্ব যুক্ত স্থানে অণুগুলি ছড়িয়ে পড়ে। এ প্রকার চাপকে ব্যাপন চাপ বলে। কোনো পদার্থের অণুর ব্যাপন ততক্ষণ চলতে থাকে যতক্ষণ না উক্ত পদার্থের অণুগুলির ঘনত্ব সর্বত্র সমান হয়। অণুগুলির ঘনত্ব সমান হওয়া মাত্রই পদার্থের ব্যাপন বন্ধ হয়ে যায়। ব্যাপন বলতে কী বুঝায় তা কয়েকটি পরীক্ষার মাধ্যমে সহজে বুঝা যায়। পরীক্ষালব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে আলোচনা করে ব্যাপন সম্বন্ধে বাস্তব জ্ঞান পাওয়া যায়। নিচে ব্যাপন প্রক্রিয়ার কয়েকটি পরীক্ষা আলোচনা করা হলো- ✯ এই পরীক্ষা থেকে তুমি কী বুঝলে, খাতায় লিপিবদ্ধ কর।

কাজ : কিছু পরিমাণ তুঁতে বিকারের পানিতে ফেলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর। তুঁতে পানিতে দ্রবীভূত হবে এবং পানির রং তুঁতের রং ধারণ করবে। কেন এমন হলো ব্যাখ্যা কর। পরিশেষে আমাদের চারপাশে সংঘটিত বিভিন্ন ব্যাপন ক্রিয়ার তালিকা তৈরি কর।

ব্যাপনের গুরুত্ব : জীবের সব রকম শারীরবৃত্তীয় কাজে ব্যাপন প্রক্রিয়ার ঘটে। যেমন- উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণের সময় বাতাসের কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে। এই অত্যাবশ্যককাজ ব্যাপন দ্বারা সম্ভব হয়। জীবকোষে শ্বসনের সময় গ্লুকোজ জারনের জন্য অক্সিজেন ব্যবহৃত হয়। ব্যাপন ক্রিয়ার দ্বারা কোষে অক্সিজেন প্রবেশ করে এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড বের হয়ে যায়। উদ্ভিদ দেহে শোষিত পানি বাষ্পাকারে প্রস্বেদনের মাধ্যমে দেহ থেকে ব্যাপন প্রক্রিয়ায় বের করে দেয়। প্রাণীদের শ্বসনের সময় অক্সিজেন ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের আদান-প্রদান ও রক্ত থেকে খাদ্য, অক্সিজেন প্রভৃতির লসিকায় বহন ও লসিকা থেকে কোষে পরিবহন করা ব্যাপন দ্বারা সম্পন্ন হয়।

দ্রবণ (Solution) : দ্রাব ও দ্রাবকের মিশ্রণের ফলে যা উৎপন্ন হয়। যেমন- চিনি (দ্রাব) ও পানি (দ্রাবক) মিশিয়ে সরবত ( দ্রবণ ) তৈরি হয়।
দ্রাব (Solute) : দ্রাবকে যা দ্রবীভূত হয়। যেমন -চিনি, লবণ ইত্যাদি
দ্রাবক (Solvent) : দ্রাব যাতে দ্রবীভূত হয়। যেমন - পানি।
অভেদ্যপর্দা : যে পর্দা দিয়ে দ্রাবক ও দ্রাব উভয় প্রকার পদার্থের অণুগুলো চলাচল করতে পারে না তাকে অভেদ্য পর্দা বলে। যেমন- পলিথিন, কিউটিনযুক্ত কোষপ্রাচীর।
ভেদ্য পর্দা : যে পর্দা দিয়ে দ্রাবক ও দ্রাব উভয়েরই অণু সহজে চলাচল করতে পারে তাকে ভেদ্য পর্দা বলে। যেমন-কোষপ্রাচীর ।
অর্ধভেদ্য পর্দা : যে পর্দা দিয়ে কেবল দ্রবণের দ্রাবক অণু (উদ্ভিদের ক্ষেত্রে পানি) চলাচল করতে পারে কিন্তু দ্রাব অণু চলাচল করতে পারে না তাকে অর্ধভেদ্য পর্দা বলে। যেমন-কোষ পর্দা, ডিমের খোসার ভিতরের পর্দা, মাছের পটকার পর্দা ইত্যাদি।

পাঠ ৩ : অভিস্রবণ
আমরা লক্ষ্য করেছি যদি একটা শুকনা কিসমিসকে পানিতে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রাখি তাহলে সেটি ফুলে উঠে। এটি কিসমিস দ্বারা পানি শোষণের কারণে ঘটে এবং পানি শোষণ অভিস্রবণ দ্বারা ঘটে। অভিস্রবণও এক প্রকার ব্যাপন। অভিস্রবণ কেবলমাত্র তরলের ক্ষেত্রে ঘটে এবং একটি অর্ধভেদ্য পর্দা অভিস্রবণের সময় দুটি তরলকে পৃথক করে রাখে। কিসমিসের উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা এখানে বুঝানো হলো।
আমরা জানি দুটি ভিন্ন ঘনত্বের দ্রবণ একত্র মিশ্রিত হলে স্বাভাবিক ভাবেই এদের মধ্যে ব্যাপন সংঘটিত হয়। লক্ষ করে দেখ কিসমিসের ভিতরের পানি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে কিসমিসগুলো কুচকে গেছে। কিসমিস খেতে মিষ্টি লাগে কারণ কিসমিসের ভিতরে পানির অণুর ঘনত্ব খুবই কম এবং চিনির অণুর ঘনত্ব খুবই বেশি। এখন কিসমিসগুলো পানিতে রাখলে, নিয়ম অনুসারে চিনির (দ্রাব) অণু পানির (দ্রাবক) দিকে এবং পানির অণু চিনির দিকে ধাবিত হবে। কিন্তু কিসমিসের ক্ষেত্রে তা ঘটছে না, কিসমিসটি শুধু পানি শোষণ করে ফুলে উঠছে। কারণ কিসমিসের ভিতরে চিনির একটি গাঢ় দ্রবণ একটি পর্দা দ্বারা পানি থেকে পৃথক হয়ে আছে। ফলে শুধু পানির অণু কিসমিসের অভ্যন্তরে ব্যাপন প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করেছে, কিন্তু চিনির অণু এই রকম পর্দা ভেদ করে বাইরে আসতে পারছে না। এ ধরনের পর্দাকে অর্ধভেদ্য পর্দা বলে। অর্থাৎ যে পর্দার মধ্য দিয়ে দ্রাবক (পানি) শুকনা কিসমিস অভিস্রবণ দ্বারা পানি শোষণের ফলে কিসমিসগুলো স্ফীত হয়েছে
এটাই অভিস্রবণ বা অসমোসিস। তাহলে অভিস্রবণের সংজ্ঞা আমরা এভাবে দিতে পারি, একই দ্রাবক (পানি) বিশিষ্ট দুটি ভিন্ন ঘনত্বের দ্রবণ একটি অর্ধভেদ্য পর্দা দ্বারা পৃথক থাকলে যে ভৌত প্রক্রিয়ায় দ্রাবক (পানি) কম ঘনত্বের (অধিক পানি ) দ্রবণ থেকে অধিক ঘনত্বের (কম পানি) দ্রবণের দিকে ব্যাপিত হয় তাকে অভিস্রবণ বা অসমোসিস বলে।

পাঠ : ৪ অভিস্রবণের গুরুত্ব বিভিন্ন প্রয়োজনীয় লবণ উদ্ভিদদেহে দ্রবীভূত অবস্থায় জীবকোষে প্রবেশ করে। জীবকোষের কোষাবরণ বা পাজমা পর্দা অর্ধভেদ্য পর্দা হিসেবে কাজ করে। পাজমা পর্দা দিয়ে অভিস্রবণ প্রক্রিয়ায় পানিতে দ্রবিভূত বিভিন্ন খনিজ লবণ কোষের মধ্যে প্রবেশ করে বা বাইরে আসে। পানি ও পানিতে দ্রবীভূত খনিজ লবণকে একত্রে কোষ রস বা সংক্ষেপে রস বলে। সুতরাং কোষের মধ্যে বিভিন্ন জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলিকে সচল রাখার জন্য অভিস্রবণের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রক্রিয়ার দ্বারা : উদ্ভিদ এককোষী মূলরোম দিয়ে মাটি থেকে পানি ও পানিতে দ্রবীভূত খনিজ লবণ শোষণ করতে পারে। কোষের রসস্ফীতি ঘটে এবং কাণ্ড ও পাতাকে সতেজ এবং খাড়া রাখতে সাহায্য করে। ফুলের পাঁপড়ি বন্ধ বা খুলতে পারে। প্রাণীর অন্ত্রে খাদ্য শোষিত হতে পারে।
কাজ : থিসল ফানেলের চওড়া মুখটি মাছের পটকায় ঢেকে সুতা দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিতে হবে এবং বিকারটিতে অর্ধেক পর্যন্ত পানি নিতে হবে। বিকারে পানি নেওয়ার পর থিসল ফানেলের নল দিয়ে চিনির গাঢ় দ্রবণ ঢেলে ফানেলের চওড়া মুখটি বিকারের পানিতে সম্পূর্ণ ডুবিয়ে ফানেলটিকে ক্ল্যাম্পের সাহায্যে স্ট্যান্ডের সাথে আটকে রাখতে হবে। এরপর ফানেলের নলে চিনির দ্রবণের তলটি মার্কার পেন দিয়ে চিহ্নিত করে পরীক্ষা -ব্যবস্থাটিকে এক স্থানে রেখে দিতে হবে।

পর্যবেক্ষণ : কিছক্ষুণ পর দেখা যাবে থিসল ফানেলের নলের দ্রবণের তল উপরের দিকে উঠে গিয়েছে। আরও কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল ফানেলের নলের দ্রবণের তল আর উপরে উঠছে না। এ পরীক্ষায় তুমি যা পর্যবেক্ষণ করলে তা নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলোর উত্তরে লেখ-
১. মাছের পটকার পর্দাটি কী ধরনের পর্দা?
২. চিনির দ্রবণ কেন ফানেলের নলের উপরে উঠে আসল?
৩. কিছুক্ষণ পর ফানেলের পানি উপরে না উঠে স্থায়ীভাবে কেন অবস্থান করল?


পাঠ : ৫ উদ্ভিদের পানি ও খনিজ লবণ শোষণ
উদ্ভিদের পানি শোষণ পদ্ধতি : মাটি থেকে পানি ও পানিতে দ্রবীভূত খনিজ লবণ উদ্ভিদ দেহের সজীব কোষে টেনে নেওয়ার পদ্ধতিকে সাধারণভাবে শোষণ বলা যেতে পারে। স্থলে বসবাসকারী উদ্ভিদগুলি মূলরোমের সাহায্যে মাটি থেকে পানি শোষণ করে। পানিতে নিমজ্জিত উদ্ভিদরা সারাদেহ দিয়ে পানি শোষণ করে। স্থলজ উদ্ভিদগুলির মূলরোম মাটির সূক্ষ্মকণার ফাঁকে লেগে থাকা কৈশিক পানি অভিস্রবণ প্রক্রিয়ায় নিজ দেহে টেনে নেয়।
মূলরোমের প্রাচীরটি ভেদ্য তাই প্রথমে ইমবাইবিশন প্রক্রিয়ায় পানি শোষণ করে এবং কোষ প্রাচীরের নিচে অবস্থিত অর্ধভেদ্য প্লাজমা পর্দার সংস্পর্শে আসে। মূলরোমের কোষীয় দ্রবণের ঘনত্বের তুলনায় তার পরিবেশের দ্রবণের ঘনত্ব কম থাকায় পানি (দ্রাবক) কোষের মধ্যে অন্তঃঅভিস্রবণ প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে। এখানে কিন্তু পানির ঘনত্ব বাইরে বেশি এবং কোষ অভ্যন্তরে কম। আমরা পূর্বে জেনেছি পদার্থের অণুগুলোর ধর্ম হচ্ছে বেশি ঘনত্ব থেকে কম ঘনত্বের দিকে ধাবিত হওয়া। তাই পানি অভিস্রবণ প্রক্রিয়ায় কোষ অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। সুতরাং শোষণ হলো ব্যাপন ও অভিস্রবণ প্রক্রিয়ার যৌথ ফল। মূলের বাইরের আবরণ থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সব কোষের কোষ রসের ঘনত্ব সমান নয়। ফলে কোষান্তর অভিস্রবণের কারণে মূলের এক কোষ থেকে অন্য কোষে পানির গতি অব্যাহত থাকে এবং পরিশেষে পানি কাণ্ডের জাইলেম বাহিকার মাধ্যমে পাতায় পৌছায়।

কাজ : প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ব্যাপন ও অভিস্রবণের পার্থক্য ছক করে পোস্টার কাগজে উপস্থাপন কর এবং শ্রেণি আলোচনায় অংশগ্রহণ কর।

ইমবাইবিশন : অধিকাংশ কলয়েডধর্মী পদার্থই পানিগ্রাহী। উদ্ভিদদেহে বিভিন্ন ধরনের কলয়েডধর্মী পদার্থ বিদ্যমান। যথা- স্টার্চ, সেলুলোজ, জিলেটিন ইত্যাদি। এসব পদার্থ তাদের কলয়েডধর্মী গুণের জন্যই পানি শোষণ করতে সক্ষম। কলয়েডধর্মী বিভিন্ন পদার্থ (উদ্ভিদের ক্ষেত্রে কোষ প্রাচীর।) যে প্রক্রিয়ায় নানা ধরনের তরল পদার্থ (উদ্ভিদের ক্ষেত্র পানি) শোষণ করে তাকে ইমবাইবিশন বলে। উদ্ভিদের খনিজ লবণ শোষণ
উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য কতগুলি খনিজ লবণের প্রয়োজন হয়। উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় খনিজ লবণের উৎস মাটিস্থ পানি। মাটিস্থ পানিতে খনিজ লবণ দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। খনিজ লবণগুলি মাটিস্থ পানিতে দ্রবীভূত থাকলেও পানি শোষণের সঙ্গে উদ্ভিদের লবণ শোষণের কোনো সম্পর্ক নেই, দুটি প্রক্রিয়াই ভিন্নধর্মী । উদ্ভিদ কখনও লবণের সম্পূর্ণ অণুকে শোষণ করতে পারে না। লবণগুলো কেবল আয়ন হিসেবে শোষিত হয়। উদ্ভিদ মাটির রস থেকে খনিজ লবণ শোষণ দুইভাবে সম্পন্ন করে। যথা : (১) নিষ্ক্রিয় শোষণ; (২) সক্রিয় শোষণ।


পাঠ ৬ : প্রস্বেদন
প্রস্বেদন বা বাষ্পমোচন উদ্ভিদের একটি বিশেষ শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। আমরা পূর্বের পাঠে জেনেছি, উদ্ভিদের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কাজের জন্য পানি অপরিহার্য। তাই উদ্ভিদ মূলরোমের সাহায্যে মাটি থেকে প্রচুর পরিমাণ পানি শোষণ করে। শোষিত পানির কিছু অংশ উদ্ভিদ তার বিভিন্ন বিপাকীয় কাজে ব্যবহার করে এবং বাকি অংশ বাষ্পাকারে বায়ুমণ্ডলে পরিত্যাগ করে। উদ্ভিদের দেহাভ্যন্তর থেকে পাতার মাধ্যমে বাষ্পাকারে পানির এই নির্গমনের প্রক্রিয়াকে প্রস্বেদন বা বাষ্পমোচন বলে।
প্রস্বেদন প্রধানত পত্ররন্ধ্রের মাধ্যমে হয়, এছাড়া কাণ্ড ও পাতার কিউটিক্ল এবং কাণ্ডের ত্বকে অবস্থিত লেন্টিসেল নামক এক বিশেষ ধরনের অঙ্গের মাধ্যমেও অল্প পরিমাণ প্রস্বেদন হয়। প্রস্বেদনের স্থানের ভিত্তিতে প্রস্বেদন তিন প্রকার যথা- ১) পত্ররন্ধ্রীয় প্রস্বেদন, ২) ত্বকীয় বা কিউটিকুলার প্রস্বেদন এবং ৩) লেন্টিকুলার প্রস্বেদন।
শ্রেণিতে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সাধারণ অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে পত্ররন্ধ্র দেখাবেন এবং খালি চোখে কাণ্ডের লেন্টিসেল দেখাবেন।


পাঠ ৭
কাজ : দুটি টবে লাগানো গাছ টেবিলের উপর রেখে গাছের গোড়ায় পরিমাণ মতো পানি দাও। একটি গাছকে পাতাযুক্ত রেখে পলিথিনের মোড়ক দিয়ে ঢেকে দিয়ে গাছের গোড়ায় পলিথিনটি সুতা দিয়ে বেঁধে ঐ স্থানে ভেসলিনের প্রলেপ দিতে হবে যাতে বাইরের থেকে বাতাস বা পানি না যেতে পারে। অপর গাছটির পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলে একইভাবে প্রথম গাছটির মতো পলিথিন মোড়ক দিয়ে ঢেকে ফেল। গাছ দুটিকে সূর্যের আলোতে রাখ।
পর্যবেক্ষণ : কিছুক্ষণ পর দেখবে পাতাযুক্ত গাছের টবে পলিথিনের ভিতরে বিন্দু বিন্দু পানি জমেছে কিন্তু পাতাবিহীন গাছের টবে পলিথিনের ভিতরে পানি জমেনি। পাতাযুক্ত গাছের টবে পলিথিনের ভিতরে কেন পানি বিন্দু বিন্দু জমেছে এবং পাতাবিহীন টবে পলিথিনে কেন পানি বিন্দু জমেনি?
এ পরীক্ষা থেকে তুমি কী প্রমাণ করলে? তোমার এ পর্যবেক্ষণ থেকে তুমি কী সিদ্ধান্তে উপনীত হবে?


পাঠ ৮ : প্রস্বেদনের গুরুত্ব উদ্ভিদ জীবনে প্রস্বেদন একটি অনিবার্য প্রক্রিয়া। প্রস্বেদনের ফলে উদ্ভিদ দেহ থেকে প্রচুর পানি বাষ্পাকারে বেরিয়ে যায়। এতে উদ্ভিদের মৃত্যুও হতে পারে। তাই আপাতদৃষ্টিতে উদ্ভিদের জীবনে প্রস্বেদনকে ক্ষতিকর প্রক্রিয়া বলেই মনে হয়। এজন্য প্রস্বেদনকে বলা হয় উদ্ভিদের জন্য এটি একটি " Necessary evil ". কিন্তু তবুও প্রস্বেদন উদ্ভিদ জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ : প্রস্বেদনের ফলে উদ্ভিদ তার দেহ থেকে পানিকে বের করে অতিরিক্ত পানির চাপ থেকে মুক্ত করে। প্রস্বেদনের ফলে কোষ রসের ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। কোষ রসের ঘনত্ব বৃদ্ধি অন্তঃঅভিস্রবণের সহায়ক হয়ে উদ্ভিদকে পানি ও খনিজ লবণ শোষণে সাহায্য করে। উদ্ভিদ দেহকে ঠান্ডা রাখে এবং পাতার আর্দ্রতা বজায় রাখে। প্রস্বেদনের ফলে খাদ্য তৈরির জন্য পাতায় অবিরাম পানি সরবরাহ সম্ভব হয়। পাতায় প্রস্বেদনের ফলে জাইলেম বাহিকায় পানির যে টান সৃষ্টি হয় তা মূলরোম কর্তৃক পানি শোষণে উদ্ভিদের শীর্ষে পরিবহনে সাহায্য করে।
উদ্ভিদের প্রস্বেদন প্রক্রিয়া সালোকসংশেষণ ও শ্বসনের মতো পরিবেশে তেমন কোনো প্রভাব রাখে না। তবে পানিচক্রে বাষ্পীভবনে অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের পানি জলীয়বাষ্প হিসেবে বায়ুমণ্ডলে প্রেরণ করতে স্থলজ উদ্ভিদের প্রস্বেদন প্রক্রিয়া ভূমিকা রাখে। প্রস্বেদনের ফলে প্রচুর পানি বাষ্পাকারে বায়ুমণ্ডলে পৌছায়। প্রাণীজ ও খনিজ লবণের পরিবহন
আমরা জেনেছি যে উদ্ভিদ মূলের মূলরোমের সাহায্যে পানি ও খনিজ লবণ মাটি থেকে শোষণ করে। এই পানি ও খনিজ লবণের দ্রবণকে কাণ্ড এবং শাখা-প্রশাখার মধ্য দিয়ে পাতায় পৌছানো দরকার। কারণ পাতাই প্রধানত এগুলিকে সালোকসংশেষণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য তৈরির রসদ হিসেবে ব্যবহার করে। আবার পাতায় তৈরি খাদ্য উদ্ভিদ তার দেহের বিভিন্ন অংশে যথা-কাণ্ড ও শাখা-প্রশাখায় পাঠিয়ে দেয়। উদ্ভিদের মূলরোম দ্বারা শোষিত পানি ও খনিজ লবণ মূল থেকে পাতায় পৌছানো এবং পাতায় তৈরি খাদ্যবস্তু সারা দেহে ছড়িয়ে পড়াকে পরিবহন বলে। শোষণের মতো পরিবহন পদ্ধতিটিও উদ্ভিদের অতি গুরুত্বপূর্ণ। উদ্ভিদের পরিবহন টিস্যু-জাইলেম ও ফ্লোয়েমের মাধ্যমে পরিবহন ঘটে। জাইলেমের মাধ্যমে মূল দ্বারা শোষিত পানি পাতায় যায় এবং ফ্লোয়েম দ্বারা পাতায় উৎপন্ন তরল খাদ্য সারা দেহে পরিবাহিত হয়। সুতরাং উদ্ভিদের পরিবহন কলা গুচ্ছ জাইলেম ও ফ্লোয়েম হলো উদ্ভিদের পরিবহনের পথ। উদ্ভিদের পরিবহন প্রক্রিয়াটি নিম্নলিখিতভাবে সম্পন্ন হয়
উদ্ভিদের মূলরোম দিয়ে পানি অভিস্রবণ প্রক্রিয়ায় এবং পানিতে দ্রবীভূত খনিজ লবণ নিষ্ক্রিয় ও সক্রিয় পদ্ধতিতে শোষিত হয়ে জাইলেম টিস্যুতে পৌছায়। জাইলেমের মাধ্যমে উদ্ভিদ দেহে রসের উর্ধ্বমুখী পরিবহন হয়। ফ্লোয়েমের মাধ্যমে পাতায় তৈরি খাদ্য রসের নিম্নমুখী পরিবহন হয়। উদ্ভিদের সংবহন বা পরিবহন বলতে প্রধানত উর্ধ্বমুখী পরিবহন এবং নিম্নমুখী পরিবহনকে বোঝায়।


পাঠ ৯-১১
মাটি থেকে মূলরোমের দ্বারা শোষিত পানি ও খনিজ লবণের দ্রবণ (রস) যে জাইলেম বাহিকার মধ্য দিয়ে পাতায় পৌছায় তা একটি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করা যায়। এ জন্য প্রয়োজন পেপেরোমিয়া উদ্ভিদ। এ গাছের কাণ্ড ও মধ্য শিরা স্বচ্ছ।
কাজ :
একটি নরম কাণ্ডের দোপাটি অথবা পেপেরোমিয়া উদ্ভিদ মাটি থেকে মূল সমেত তুলে তার মূলগুলো পানিতে ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। এখন একটি বিকারে পানি নিয়ে তাতে কয়েক ফোঁটা লাল রং মিশাতে হবে। এবার গাছের মূলসহ অংশটি রঙ্গিন পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে।
কয়েক ঘণ্টা পরে দেখা যাবে যে কাণ্ড এবং পাতার শিরাগুলো লাল রঙ ধারণ করেছে। গাছটি বিকার থেকে তুলে কাণ্ডের প্রস্থচ্ছেদ বা লম্বচ্ছেদ করে অণুবীণ যন্ত্রে দেখ এবং তা লিপিবদ্ধ কর। তোমার পর্যবেক্ষণ থেকে তুমি কী সিদ্ধান্তে উপনীত হবে এবং এতে কী প্রমাণ হলো।


নতুন শব্দ
ব্যাপন, অন্তঃঅভিস্রবণ, অর্ধভেদ্য পর্দা, বহিঃঅভিস্রবণ, ভেদ্য পর্দা, আয়ন, কোষ রস, সক্রিয় শোষণ, অভিস্রবণ, নিষ্ক্রিয় শোষণ, প্রস্বেদন।


এ অধ্যায় পাঠ শেষে যা শিখলাম-
- ব্যাপন ও অভিস্রবণ প্রক্রিয়া কী?
- উদ্ভিদ-ব্যাপন ও অভিস্রবণ প্রক্রিয়ায় পানি খনিজ লবণের আয়ন মাটিস্থ দ্রবণ থেকে সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় প্রক্রিয়ায় মূলের মূলরোম দ্বারা শোষণ করে।
- উদ্ভিদের জাইলেম দিয়ে পানি ও পানিতে দ্রবীভূত খনিজ লবণ পাতায় পরিবাহিত হয়।
- উদ্ভিদের ফ্লোয়েম দিয়ে পাতায় তৈরি খাদ্য উদ্ভিদ দেহের শাখা ও প্রশাখায় পৌঁছায়।
- প্রস্বেদনের ফলে খাদ্য তৈরির জন্য পাতায় অবিরাম পানি সরবরাহ সম্ভব হয়।
- প্রস্বেদনের ফলে জাইলেম বাহিকায় যে টান সৃষ্টি হয় তা মূলরোম কর্তৃক পানি শোষণে সাহায্য করে।